গড়াই কুমারখালী উপজেলার অন্যতম প্রধান নদী। এটি পদ্মার একটি অন্যতম শাখা নদী। কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন মাইল উত্তর পশ্চিমে তালবাড়িয়ার নিকট পদ্মা থেকে বেড় হয়ে গড়াই নদী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মধ্যে দিয়ে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ পাশ দিয়ে কুমারখালী শহরের প্রদক্ষিণ করে খোকসা-পাংশার দিকে প্রবাহিত। মূল পদ্মা নদী কুমারখালীর শিলাইদহ ও জগন্নাথপুর ইউনিয়নের পাশ দিয়ে খোকসা হয়ে গোয়ালন্দে গিয়ে মিশে গেছে। গড়াই নদীর তীরেই কুমারখালী শহর অবস্থিত ।
হাজার বছর ধরে বাঙালি হেঁটেছে বাংলার পথে-প্রান্তরে। কর্ণফুলী থেকে তিস্তামুখ পর্যন্ত ঘুরেছে তারা। বাঙালি প্রাচীন জাতি। অনেক পুরোনো তার সভ্যতা। তার অনেক কিছু ছিল, ছিল না শুধু ব্রিজ। বাঙালির জীবনে ব্রিজ যোগ হয় উনিশ শতকে।
বাংলাদেশে প্রথম সবচেয়ে বড় ব্রিজটি নির্মাণ করা হয় কুষ্টিয়ায়, গড়াই নদীর ওপর। রেলওয়ে ব্রিজ। বড় লাট লর্ড মেয়ো ছিলেন সুযোগ্য শাসনকর্তা। গড়াই নদীর ব্রিজটি তাঁর সময়েই তৈরি। গড়াই সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে ১৮৭৩ সালে মীর মশাররফ হোসেন প্রকাশ করেন তাঁর কবিতা পুস্তিকা গোড়াই ব্রিজ বা গোড়ী সেতু। ওই পুস্তিকা সম্পর্কে বঙ্কিমবাবুর বঙ্গদর্শন লিখেছিল, ‘ইহার পদ্য মন্দ নহে। মীর সাহেবের ‘গোড়াই ব্রিজ’ হারিয়ে গেলেও গড়াই সেতুটি রয়ে গেছে আজও। সেকালে প্রযুক্তি আজকের চেয়ে বেশি উন্নত ছিল না। কিন্তু যা ছিল তার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে।
নাইজেল স্মলার ও অড্রিন স্মলার দুই সহোদর। তাদের বাবা অল্ডউইন স্মলার ছিলেন তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানীর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার। অল্ডউইন স্মলারের কর্মস্থল ছিলো কুষ্টিয়া। ১৯৩৭ সালে কুমারখালীতে গড়াই নদীর ওপর রেলওয়ে ব্রিজের কাজ শুরু হলে তিনি ছিলেন সার্বিক দায়িত্বে। ব্রিজটির নির্মাণ কাজ ১৯৩৭ সালে শুরু হয়ে সম্পন্ন হয় ১৯৩৯ সালে। বৃটিশ নাগরিক অল্ডউইন ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ের প্রকৌশলীর চাকরি নিয়ে ভারতে আসেন ত্রিশের দশকে প্রথমদিকে। তাঁর কর্মস্থল নির্ধারণ হয় কুষ্টিয়াতে। নাইজেলের নানা ব্রিটিশ নাগরিক হলেও চাকরিসূত্রে বসবাস করতেন ভারতের নাগপুরে। তাঁর মেয়ে তেরেসার সঙ্গে অল্ডউইনের বিয়ে হয়। ১৯৫১ সালে অল্ডউইন ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৯৭৮ সালের ১৯ অক্টোবর ৭৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মারা যাবার পূর্বে তিনি বড় ছেলে নাইজেল স্মলারকে অনেক ছবি দেখান ও গড়াই ব্রিজ তৈরির গল্প বলেন। বলেন বাংলাদেশ তথা কুষ্টিয়া-কুমারখালির অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা। বাবার মৃতু্যর ২ বছর পর হঠাৎই যেন নাইজেল আক্রান্ত হন নষ্টালজিয়ায়। বাবার সৃষ্টি গড়াই ব্রিজ দেখতে হবে। সেই থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু। কিন্তু সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না। ৩০ বছর ধরে স্বপ্ন দেখার পর গত ২৮ মার্চ নাইজেল স্মলার ও তার ছোটভাই অড্রিন স্মলার এবং ভিয়েতনামী বন্ধু হুয়াং লি বাংলাদেশে আসেন।
৩০ মার্চ কুমারখালী প্রেসক্লাব থেকে মাইক্রো গড়াই ব্রিজের দিকে যতো এগুতে থাকে, ততোই আবেগতাড়িত হতে থাকেন স্মলার ভ্রাতৃদ্বয়। অবশেষে স্বপ্নের গড়াই ব্রিজ। স্পন্দিত বুকের স্পর্শ নিয়ে স্বপ্ন নেমে আসে ধরাতলে। আবেগে আপস্নুত, বাকরুদ্ধ স্মলার দুইভাই। বাবার সৃষ্টি তারা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখেন। যেনো বাবাকেই ছুঁয়ে দেখছেন তারা গভীর মমতায়। গড়াই ব্রিজ, আর এই আমাদের বাবা। তারা বলেন, বাবা এই ব্রিজ তৈরির অনেক গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। শুনিয়েছের এদেশের প্রকৃতি, লালন, টেগর ও এদেশের মানুষের কথা। নাইজেল স্মলার পেশায় একজন মানসিক রোগের চিকিৎসক ও তার ভাই অড্রিন স্মলার ব্যাংকার। নাইজেল বলেন, আমরা চারভাই, মা আছেন। তাঁর বয়স ৭৪ বছর। আমরা এ ব্রিজের ছবি ও ভিডিও চিত্র দেশে গিয়ে আমাদের মা ও অন্য দুইভাইকে দেখাবো। আমাদের বন্ধুদের দেখাবো বাবার সৃষ্টি।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস